বাংলার মাঠেঘাটে, পথের ধারে, বা পরিত্যক্ত জমিতে আমরা প্রায়ই একধরনের কাঁটাযুক্ত গাছ দেখে থাকি। অনেকেই এটিকে সাধারণ আগাছা ভেবে উপড়ে ফেলি। কিন্তু এই “আগাছা”টিই হলো পিপুল শাক, একটি অপারগুণসম্পন্ন ভেষজ উদ্ভিদ। আয়ুর্বেদ থেকে শুরু করে লোকায়ত চিকিৎসায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। চলুন আজএই অবহেলিত কিন্তু গুণে ভরপুর পিপুল শাককে।
পিপুল শাক চেনার উপায়
পিপুল গাছ সাধারণত ২-৪ ফুট লম্বা হয়। এর পাতাগুলো যৌগিক ধরনের হয়, অর্থাৎ একটি ডালে অনেকগুলো ছোট ছোট পাতা সাজানো থাকে। গাছের কাণ্ড ও পাতার বোঁটায় সূক্ষ্ম কাঁটা থাকে যা স্পর্শ করলে হাতে ফুটো দিতে পারে। এর ফুল ছোট ছোট এবং সাদা রঙের হয়। পিপুল শাক বলতে আমরা সাধারণত এর কচি ডগা এবং পাতাগুলোকে বুঝি যা রান্না করার জন্য সংগ্রহ করা হয়।
পিপুল শাকের পুষ্টিগুণ: কেন খাবেন?
পিপুল শাককে “স্বাস্থ্যরত্ন” বলার পেছনে রয়েছে এর অসাধারণ পুষ্টি ও ভেষজ গুণ। এটি ভিটামিন, মিনারেল এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে ভরপুর।
১. ব্যথানাশক ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণ:
পিপুল শাকের সবচেয়ে বিখ্যাত গুণ হলো এটি ব্যথা কমাতে পারে, বিশেষ করে বাতের ব্যথা এবং গাঁটে গাঁটে ব্যথায়। এতে রয়েছে প্রাকৃতিক অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি (বিষফোলনাশক) উপাদান যা শরীরের বিভিন্নফোলা ও ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। অনেকেই পিপুল পাতার রস বা এর ক্বাথ (জলসিদ্ধ) ব্যথার স্থানে মালিশ করেন।
২. পাচকতন্ত্রের জন্য উপকারী:
এটি হজমশক্তি বাড়াতে এবং পেটের বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে খুবই কার্যকর। পিপুল শাক কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, পেট ফাঁপা কমায় এবং অ্যাসিডিটি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এতে ডায়েটারি ফাইবার থাকায় এটি পরিপাকতন্ত্রকে সচল রাখে।
৩. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি:
পিপুল শাকে ভিটামিন-সি এবং অন্যান্য শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে। নিয়মিত intake সর্দি-কাশি, জ্বর এবং সাধারণ সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
৪. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক:
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে পিপুল শাক রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। এটি ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা বাড়াতে পারে বলে ধারণা করা হয়।
৫. ত্বক ও চুলের জন্য ভালো:
অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণের কারণে পিপুল শাক ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা যেমন ব্রণ, ফুসকুড়ি, একজিমা ইত্যাদি কমাতে সাহায্য করে। এটি চুলের গোড়া শক্ত করতেও ব্যবহৃত হয়।
৬. রক্ত শুদ্ধিকরণ:
আয়ুর্বেদ মতে, পিপুল শাক রক্ত পরিশোধনকারী (Blood Purifier) হিসেবে কাজ করে। এটি রক্ত থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর করে ত্বক ও সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।
পিপুল শাক সংগ্রহ ও প্রস্তুতির সময় সতর্কতা
· শুধুমাত্র কচি, সবুজ ডগা এবং পাতাই সংগ্রহ করুন। পুরানো, শক্ত ও হলদেটে পাতা এড়িয়ে চলুন।
· গাছের কাঁটাযুক্ত অংশগুলি সাবধানে ছেঁটে নিন।
· সংগ্রহ করার পর খুব ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে যাতে ময়লা বা ধুলোবালহয়।
· যেহেতু এটি বুনো গাছ, তাই দূষণমুক্ত স্থান থেকে সংগ্রহ করা
পিপুল শাক দিয়ে সহজ ও মুখরোচক রেসিপি
পিপুল শাক দিয়ে বিভিন্ন ধরনের তরকারি রান্না করা যায়।জনপ্রিয় হলো পিপুল শাক দিয়ে মাছের তরকারি (বিশেষ করে চিংড়ি বা ছোট মাছ দিয়ে)। এছাড়া ডালে দিয়েও রান্না করা যায়।
উপকরণ:
· তাজা পিপুল শাক – ১ বাটি (ধুয়ে পরিষ্কার করে)
· ছোট মাছ বা চিংড়ি – ২০০ গ্রাম
· পেঁয়াজ বাটা – ২ টেবিল চামচ
· রসুন বাটা – ১ টেবিল চামচ
· হলুদ গুঁড়া – ১ চা চামচ
· মরিচ গুঁড়া – স্বাদমতো
· জিরা গুঁড়া – ১/২ চা চামচ
· তেল – প্রয়োজনমতো
· লবণ – স্বাদমতো
রান্নার পদ্ধতি:
১. প্রথমে পিপুল শাকটি ভালো করে ধুয়ে নিন এবং কাঁটাযুক্ত部分尽可能去除 করে কেটে নিন।
২.একটি পাত্রে তেল গরম করুন। তেলে পেঁয়াজ বাটা দিয়ে হালকা বাদামি হয়ে না আসা পর্যন্ত ভাজুন।
৩.এবারে রসুন বাটা, হলুদ, মরিচ ও জিরা গুঁড়া দিয়ে কিছুক্ষণ ভাজুন।
৪.মাছ বা চিংড়ি দিয়ে নেড়ে-চেড়ে ভাজুন যতক্ষণ না বর্ণ পরিবর্তন হয়।
৫.এবার পিপুল শাক দিয়ে দিন এবং ভালো করে কষিয়ে নিন। শাক নরম হয়ে এলে এবং water released হলে。
৬.প্রয়োজনমতো পানি, লবণ দিয়ে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে মাঝারি আঁচে সিদ্ধ করুন।
৭.যখন তেলের একটি layer উপরে ভেসে উঠবে এবং gravy আপনার পছন্দের consistency এ চলে আসবে, তখনি নামিয়ে ফেলুন।
৮.গরম গরম ভাতের সাথে পরিবেশন করুন।
উপসংহার
আমাদের চারপাশে এমন অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে যা আমরা চিনি না বা গুরুত্ব দেই না। পিপুল শাক তার মধ্যে একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। এটি শুধু একটি বিনামূল্যের খাদ্যই নয়, এটি একটি প্রাকৃতিক ওষুধও বটে। স্বাদের দিক থেকে এটি একটু তিতকুটে লাগতে পারে, কিন্তু এর স্বাস্থ্য উপকারিতার কথা মনে করলে সেই তিতকুটে স্বাদই মধুর মনে হবে। তাই এবার পিপুল গাছ দেখলে সেটিকে উপড়ে ফেলবেন না, বরং সযতনে সংগ্রহ করে বানিয়ে ফেলুন এক পাত্র পুষ্টিকর ও সুস্বাদু তরকারি। আপনার ডায়েটে এই প্রাকৃতিক শক্তিঘরকে একটি স্থান দিন, সুস্থ থাকুন

0 Comments